লাখ টাকায় বাঁচল ৩৭ প্রকল্প
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পে মাত্র ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ প্রকল্পটি আগামী মাসেই (জুন) শেষ হওয়ার কথা। এমন অবস্থায় শুধু প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখতেই আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০টি হাইওয়ে পুলিশ আউট পোস্ট নির্মাণের জন্য ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১০ সালে নেওয়া হয়। দুই বছরের এই প্রকল্পের মেয়াদ এর আগে দুবার বাড়ানো হয়েছে। মামলার কারণে প্রকল্পটি শেষ করা যায়নি। তাই আগামী এডিপিতে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ টাকা।
বান্দরবান এ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কেরানির হাট থেকে বান্দরবান শহর পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কটির মান উন্নয়নে গত বছরের জুলাই মাসে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্প পাসের মধ্যেই সবকিছু সীমাবদ্ধ। প্রকল্পটির জন্য চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ টাকা। এভাবে চললে ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ করতে হলে শেষ বছরে প্রকল্পের সব টাকা অর্থাৎ ২৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে এভাবেই বহু প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখা হয়। গত মঙ্গলবার পাস হওয়া আগামী অর্থবছরের এডিপিতে এমন ৩৭টি প্রকল্প আছে। এই প্রকল্পগুলো এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে আগামী বছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা যায়, প্রকল্পগুলোকে অনেকটা ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়ার মতো কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা হল। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের বক্তব্য হলো, এসব প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য কাজ বাকি থাকায় এবং মেয়াদ না থাকায় এগুলোকে এডিপিতে প্রতীকী বরাদ্দ হিসেবে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
বছরের পর বছর নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়ার ফলে প্রকল্পগুলোর খরচ ও সময়—দুটোই বেড়ে যায়। ফলে নির্ধারিত সময় প্রকল্প শেষ হয় না। এডিপিতে শুধু প্রকল্পের সংখ্যাই বাড়ে। গত ১০ বছরে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু অর্থের অপচয় হচ্ছে বললে কম বলা হবে। একটি প্রকল্পে টাকা পেতে হলে তো সময় দিতে হয়, কাগজে–কলমে কাজ করতে হয়। এক লাখ টাকার জন্য এই কাজগুলো করতে হয়। এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে এডিপিকে শুধু ভারী করা হচ্ছে। কোনো যুক্তিতেই এটা মানা যায় না।
জাহিদ হোসেন প্রশ্ন তোলেন, এক লাখ টাকায় প্রকল্পে কী কাজ করা হয় এবং কী স্বার্থে এক লাখ টাকার প্রকল্প এডিপিতে রাখা হয়, তা জানা দরকার। লাখ টাকা বরাদ্দ মানেই সময় ও অর্থের অপচয়।
এক লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া ৩৭টি প্রকল্পের তালিকায় অবশ্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও আছে। যেমন পুলিশ বিভাগের জন্য ১৯টি ইউনিটে ১৯টি অস্ত্রাগার নির্মাণ; স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রকল্প; অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন; গোপালগঞ্জে শেখ রেহানা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন; রংপুরের পীরগঞ্জে ড. এম ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নির্মাণ; শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নির্মাণ ইত্যাদি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক সময় প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু পরে বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট থাকে না। আবার প্রকল্পগুলো এডিপি থেকে বাদও দেওয়া যায় না। প্রকল্প পাসের পর জমি অধিগ্রহণে নানা জটিলতা তৈরি হয়। মামলা–মোকদ্দমায় প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা যায় না। আবার বিদেশি সহায়তা পাওয়া গেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, এমন প্রত্যাশায় কিছু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে বিদেশি সহায়তা পাওয়া যায় না, প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয় না। যেহেতু প্রকল্প এডিপি বইয়ে ঢুকে যায়, তাই বছর বছর এক-দুই লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার এডিপি নেওয়া হয়েছে। এডিপিতে বরাদ্দসহ মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ৪৭৫।